এমসিসি’র ‘দাদাগিরি’ বন্ধ করেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত

0

▪সন্দীপ দে▪

আজ,২৪ সেপ্টেম্বর। বিশ্বনাথ দত্তর তৃতীয় মৃত‍্যু বার্ষিকী। গত বছর তাঁর দ্বিতীয় মৃত‍্যু বার্ষিকীর দিনে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-এর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। বিশ্বনাথ দত্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ সেই প্রতিবেদনটাই আবারও তুলে ধরা হল।

ঘটনা -১
আইসিসির প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা বরাবরই ঠিক করত এমসিসি। রীতিমত দাদাগিরি। ব‍্যাপারটা মানতে পারতেন না বিশ্বনাথ দত্ত। তিনি বিসিসিআইয়ের সভাপতি হলেন ১৯৮৮ সালে। তার পরের বছরই (১৯৮৯) উপমহাদেশের কর্তাদের নিয়ে প্রথম বিপ্লব শুরু করেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। তিনি প্রশ্ন তুললেন, আইসিসির প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা এমসিসি ঠিক করার কে? তাঁর সেই আন্দোলনের ফলে সেই বছরই এমসিসি বাধ‍্য হয়ে আইসিসির সম্ভাব‍্য প্রেসিডেন্টের একটা তালিকা বিশুবাবুকে পাঠানো হয়। বিশুবাবু তখন কলিন কাউড্রেকে আইসিসির প্রেসিডেন্ট করতে বলেন। সেটাই হয়েছিল। বাঙালির হাত ধরে সেই থেকে আইসিসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমসিসির ক্ষমতা খর্ব হয়।

ঘটনা -২

১৯৮৯-‘৯০ মরসুমে ভারতীয় ক্রিকেট টিম গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। ওই সময় বোর্ডের চুক্তি ভেঙে কপিল দেব,দিলীপ বেঙ্গসরকার, রবি শাস্ত্রী, আজহারউদ্দিন, কিরন মোরে ও অরুণ লাল আমেরিকায় একটা টুর্নামেন্ট খেলতে চলে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনায় ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিলেন বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি বিশ্বনাথ। উল্লেখ‍্য, ওই সময় ভারতীয় দলে এই ছয় ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স,জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাঁদের ছাড়া ভারতীয় দল গড়া অসম্ভব। কিন্তু বিশুবাবু মনে করতেন, যত বড়ই খেলোয়াড় হোক না কেন, নিয়ম সবার জন‍্য এক। ওই সময় দিল্লি ক্রিকেট সংস্থা, ক্রিকেটারদের পক্ষে আদালতে যায়। কপিল দেবদের সমর্থনে ২৬ জন কংগ্রেস সাংসদ পার্লামেন্টে ঝড় তুলেছিলেন। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। আমেরিকায় টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার জন‍্য কপিল দেব সহ ছয় ক্রিকেটারকে এক বছরের জন‍্য নির্বাসনে পাঠিয়ে ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত।

ঘটনা – ৩

তাঁর জমানাতেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকদের ‘জোকার’ বলেছিলেন মহিন্দার অমরনাথ। তাঁর এই মন্তব‍্যর জন‍্য অমরনাথকে দল থেকে বাদ দিয়েছিলন বিশ্বনাথ দত্ত।

ঘটনা – ৪

বিশ্বরেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কপিল দেব। পারফরম্যান্স খারাপ। নির্বাচকরা কপিলকে দলে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। কিন্তু বিশুবাবুই কপিল দেবকে দলে ফিরিয়ে ছিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলে বিশ্বনাথ দত্ত নাকি বলেছিলেন, কপিল দেবের মত ক্রিকেটার বারবার আসে না। দেশের হয়ে ঘাম,রক্ত ঝড়িয়েছে। কপিল একটা রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর এটা প্রাপ‍্য। বোর্ডের উচিত দলে ফিরিয়ে নিয়ে কপিলকে যথাযথ সম্মান জানানো।

বিশ্বনাথ দত্ত। তাঁকে বলা হয় ময়দানের ভীষ্ম। আজ, তাঁর তৃতীয় মৃত‍্যু বার্ষিকীতে লিখতে গিয়ে অনেক কিছুই বাদ পড়বে আমি নিশ্চিত। এত ছোট্ট পরিসরে বিশুবাবুকে বিশ্লেষন করা যায় না। তবু আমরা -‘ইনসাইড স্পোর্টসে’র সাধ‍্যমত শ্রদ্ধার্ঘ‍্য জানাতেই এই লেখার চেষ্টা মাত্র।

ময়দানের ‘বিশুদা’ মাঠ শুরু করেছিলেন নিজেদের জর্জ টেলিগ্রাফ স্পোর্টস ক্লাবের মধ‍্যে দিয়ে। ক্রীড়া প্রশাসক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ফুটবলে। পরে এসেছেন ক্রিকেটে (সিএবি,বিসিসিআই)।

১৯৫০ সাল। জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাবের তৎকালীন সচিব শান্তি চ‍্যাটার্জির উদ‍্যোগে প্রথম আইএফএ-র গভর্নিং বডির নির্বাচনে লড়াইয়ে নামলেন মাত্র ২৫ বছরের যুবক বিশ্বনাথ দত্ত। আইএফএতে তখন পঙ্কজ গুপ্ত ও বেচু দত্ত রায় (এম দত্ত রায়)-এর যুগ। শান্তিবাবু এবং রাজস্থান ক্লাবের বিনায়ক হিম্মৎসিংকার সমর্থন নিয়েও বিশ্বনাথ দত্ত প্রথম নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। ভোট পেয়েছিলেন মাত্র দুটি। পরের বছর লড়াইয়ে নেমে ফের হারলেন। ভোট পেলেন ৬ টি। তৃতীয়বার গভর্নিং বডির নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতলেন।
১০ বছর পর পেলেন আইএফএর গুরুদায়িত্ব।
১৯৬২ তে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আইএফএ-র ত‍ৎকালীন অ‍্যাকাউন্টেন্ট স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন‍্য সংস্থার তহবিল থেকে ৮০ হাজার টাকা গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন শিশুসুলভ কার্যকলাপ মানতে পারেননি আইএফএ-র সভাপতি অতুল‍্য ঘোষ। সে এক তুলকালাম কান্ড। অ‍্যানুয়াল রিপোর্টে আইএফএ-র আর্থিক বার্ষিক হিসেবে জালিয়াতির অভিযোগ এনে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার পি কে সেন সচিব বেচু দত্তরায়কে গ্রেফতার করতে তৈরি হলেন। পরে বেচুবাবু নির্দোষ প্রমান হওয়ায় তাঁকে গ্রেফতার হতে না হলেও সচিব পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল অতুল‍্য ঘোষের নির্দেশে। সেই সময় তিন জনের কমিটি (কর্নেল আর কে দত্ত, গোলাম নবি, বিশ্বনাথ দত্ত) করা হল। বলা হল আপাতত এই কমিটিই আইএফএ চালাবে। ১৯৭০-‘৭৪ সালে একক ভাবে প্রথম আইএফএর সচিব হলেন বিশ্বনাথ দত্ত। তারপর তো ইতিহাস।

দীর্ঘ ১২ বছর আইএফএ সচিব থাকার পরে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। অশোক ঘোষকে দায়িত্ব দিয়ে একটা বছর শুধু জর্জ নিয়েই যেন অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন। একদিন ইস্টবেঙ্গলের কালু রায়চৌধুরী (জ‍্যোতিষ গুহর ঘনিষ্ঠ) জর্জ তাঁবুতে এসে বলেন, “বিশু, এবার সিএবিটা ধরো। ঠিক ভাবে চলছে না।” সিএবিতে তখন এন সি কোলে, নরনারায়ণ চ‍্যাটার্জি, অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ, শম্ভু পানের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কর্তা। তাদের হারিয়ে সিএবিতে যাওয়া কঠিন হলেও শেষ পযর্ন্ত সিএবির ক্ষমতায় বসেন বিশ্বনাথ দত্ত। বাকিটা তো ইতিহাস।
তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছেন জগমোহন ডালমিয়া। ভারতীয় ক্রীড়া জগতে বিশ্বনাথ দত্ত হলেন কিংবদন্তি। তিনি ছিলেন শান্ত অথচ দাপুটে। ছোট বেলায় বাবার নির্দেশে বিপ্লবীদের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতেন। যে কারণে কলকাতা ছেড়ে তাঁকে থাকতে হয়েছিল মাজদিয়া বা শান্তিপুরে। তাঁর সেই তেজ দেখা গিয়েছে ক্রীড়া প্রশাসনে।
তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতেন। পুরনো রাগ মনে রাখতেন না। তবু,একটা সময় তাঁরই অনুগামীরা বিশ্বাসঘাতকতা করে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছিল। সেই বিশ্বাসঘাতকতা করার সেই ‘রিং মাস্টার’ও আজ পৃথিবীতে নেই। আজ, বিশ্বনাথ দত্তর মৃত‍্যু দিবসে সেই বিশ্বাসঘাতকদের নাম নাইবা উল্লেখ করলাম। ময়দান জানে সেই সব কথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here