◆সন্দীপ দে◆
দীপক দাস। পুলিশের প্রাক্তন ফুটবলার। প্রাক্তন রেফারি এবং একটা সময় (১৯৯৭’৯৮) রেফারি সংস্থার সচিব ও সভাপতিও (২০০৫’০৬) ছিলেন। দীপক দাস এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে আইএফএ ও রাজ্য রেফারি সংস্থার কাছে আবেদন করেছে দীপকবাবুর পরিবার। রেফারি সংস্থার কর্তারা নিজেদের ফান্ড থেকে সাধ্যমত পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইএফএ কি করবে তা জানা যায়নি।
প্রাঞ্জল ব্যানার্জি। এই মুহুর্তে বাংলা তথা ভারতের উন্নত মানের রেফারি। তিনি একটা চাকরি চেয়েছিলেন। দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও লক্ষ্মীরতন শুক্লার কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত চাকরিটা হয়নি। নিজের পরিবার বাঁচাতে দেশের অন্যতম সেরা রেফারি প্রাঞ্জল কলকাতা ছেড়ে শিলিগুড়ি গেলেন টেকনোর চাকরি করতে। দেড় বছর বাংলা ফুটবলের মূল স্রোত থেকে সরে গিয়েছিলেন। যদিও কয়েক মাস আগে টেকনো কর্তৃপক্ষ প্রাঞ্জলকে কলকাতায় নিজেদের স্কুলে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রাঞ্জল এখন অফিসে লম্বা ছুটি নিয়ে আইএসএলের ম্যাচ খেলানোর সুযোগ পেয়েছেন।
বাংলার রেফারিদের মহলে এমন ঘটনা একাধিক। ৯০ মিনিট মাঠে বাঁশি হাতে ‘দাপট’ দেখালেও রেফারিদের বাকি সময় ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মত অবস্থা। ম্যাচের আগে, পরে ক্লাব কর্তাদের লাল চোখ দেখা, পান থেকে চুন খসলেই ভাল ম্যাচে পোস্টিং না দেওয়ার জন্য কিছু ক্লাবের প্রভাবশালী কর্তার অন্যায় চেষ্টা। এ যেন জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। কোথায় যাবেন রেফারিরা? তাঁদের এই পেশায় না আছে ভদ্রস্থ টাকা (আইলিগ, আইএসএল ছাড়া), না আছে সম্মান। তাঁদের পায়ে পায়ে সন্দেহ তাঁড়া করে। প্রতিটা মূহুর্তে, প্রতি ম্যাচেই তাঁদের পরীক্ষায় বসতে হয়। কোনও ক্লাবের আড্ডায় বসতে পারবেন না। ক্লাব কর্তা, ফুটবলারদের থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখতে হয়। যদি সখ্যতা ফাঁস তাহলেই রেফারি হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে মিডিয়া, অন্যজনেরাও। ময়দানের সন্দেহের আতসকাঁচের নিচে ফেলে রেফারিদের প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যেই রাখা হয়। থ্যাঙ্কলেস জব।
এত কিছুর পরেও ওঁরা মাঠে আসেন। কেমন আছেন তাঁরা? ভাল নেই। গত মার্চ মাস থেকে প্রায় দশ মাস মাঠে খেলা নেই। করোনার কারণে গত দশ মাসে রেফারিদের কোনও রোজগার ছিল না। কলকাতা লিগ ও জেলা লিগ না হওয়ায় আর্থিক সঙ্কটে বাংলার রেফারিরা।
গত এক মাস থেকে পাড়ায় পাড়ায় কিছু টুর্নামেন্ট হচ্ছে। সেই সব টুর্নামেন্টে ম্যাচ খেলিয়ে খুব সামান্য টাকা পাচ্ছেন ওরা। টুর্নামেন্ট সংগঠকরা করোনা দেখিয়ে রেফারিদের ম্যাচ ফি অর্ধেক করে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে তাই খেলাচ্ছেন।
কলকাতা লিগ না হওয়ায় সমস্যা বেশি। কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের একটা ম্যাচ খেলানোর জন্য রেফারি ৫০০ টাকা পান। চ্যারিটি ম্যাচ (ডার্বি ম্যাচ) হলে পান ১২০০ টাকা। প্রিমিয়ার থেকে যত নিচের দিকের ডিভিশনের ম্যাচ খেলাবেন তাতে ম্যাচ পিছু রেফারিরা পেয়ে থাকেন যথাক্রমে ৪৫০ টাকা, ৩৫০ টাকা ও ২৫০ টাকা করে। প্রাক্তন রেফারি জয়ন্ত ব্যানার্জি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন, “রেফারিরা সব সময় নেগলেকটেড। আইলিগ ও আইএসএলে টাকা আছে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্য। যারা আই লিগে ম্যাচ খেলানোর সুযোগ পান তাঁরা ম্যাচ পিছু পেয়ে থাকেন প্রায় সাত হাজার টাকা করে। সব কিছু ধরে। আই এসএলে ম্যাচ ফি প্রায় ১১ হাজার টাকা করে। অথচ আইএসএলে যে সমস্ত বিদেশি রেফারি ম্যাচ খেলান তাঁরা ম্যাচ পিছু পেয়ে থাকেন প্রায় ৩০ হাজার টাকা। ভাবাই যায় না। বাংলার সব রেফারি আই লিগ ও আইএস এলে খেলানোর সুযোগ পান না। কাজেই বাংলার বেশি সংখ্যার রেফারিদের নির্ভর করে থাকতে হয় কলকাতা লিগের উপর। এবার পরিস্থিতিটা বুঝে নিন।”
“এই বছর আমাদের ছেলেদের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। প্রথমত, আর্থিক ক্ষতি। কোনও রোজগার নেই। দ্বিতীয়ত, যাদের ৪৩ বছর পেরিয়ে গেল তারা আর এআইএফএফের কোনও টুর্নামেন্টে খেলাতে পারবে না। কোনও রেফারির ৪৪ বছর হয়ে গেলে এআইএফএফের কোনও ম্যাচ খেলাতে পারবে না। আমাদের তিন জন রেফারি আছে যাদের ৪৪ বছরে পড়ে গেল। গত দশ মাসে তাদের শেষ বছরটা আর খেলাতে পারল না।” ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে কথা গুলি বলছিলেন ক্যালকাটা রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি চিত্ত দাস মজুমদার। উল্লেখ্য, এআইএফএফে রেফারির ৪৪ বছর বয়সের নিয়ম থাকলেও কলকাতা লিগে ৫০ বছর বয়স পযর্ন্ত রেফারি ম্যাচ খেলাতে পারেন, যদি তিনি ম্যাচ ফিট থাকেন।
প্রাক্তন রেফারি চিত্তবাবুর কাছে জানা গেল, বাংলার এই রেফারি সংস্থায় প্রায় ৩০০ এরও বেশি রেফারি নথিভুক্ত আছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৭৫ জন সক্রিয়। বাংলা থেকে ফিফা প্যানেলে আছেন (পুরুষ বিভাগ) প্রাঞ্জল ব্যানার্জি, সমর পাল ও অসিত সরকার। আর মহিলা বিভাগে আছেন কনিকা বর্মন।
সংস্থার ৩০০ রেফারিদের মধ্যে বেশির ভাগ রেফারিদের চাকরি নেই। অতীতে প্রদীপ নাগ, সুমন্ত ঘোষ, সাগর সেন,দীপক দাস, ভোলানাথ দত্ত, চিত্ত দাস মজুমদাররা চাকরি করতে করতে রেফারি হয়েছেন। এখন বেশির ভাগ রেফারি বেকার। চাকরি নেই। স্পোর্টস কোটায় যদি ফুটবলারদের চাকরির হয়, তাহলে রেফারিদের চাকরি হবে না কেন? প্রতি বছর সেরা রেফারিদের কেন চাকরি দেওয়া যায় না? আইএফএ বা রাজ্য সরকারের সঙ্গে আপনারা কথা বলেছেন? উত্তরে চিত্তবাবু জানান, “আমরা একবার ক্রীড়ামন্ত্রীকে এই চাকরির ব্যাপারে বলা হয়েছে। উনি হয়তো চেষ্টা করবেন। চাকরির সুযোগ থাকলে অনেকেই রেফারি হতে মাঠে আসবেন। এখন সেভাবে আর রেফারি হতে আসে না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। পরিস্থিতি খুব খারাপ।” বলছিলেন চিত্ত দাস মজুমদার।
তাহলে রেফারি সংস্থার রেভিনিউ কি? জানা গেল, সারা বছরে নিজেদের সংস্থার মাঠ খেলার জন্য মাঝে মাঝে ভাড়া আর দেয়। আর আছে এক মাত্র স্পনসর শ্যাম স্টিল। একটা সময় রেফারি সংস্থার স্পনসর ছিল অফিসার্স চয়েস ও আর্টেজ। চার বছরের চুক্তি ছিল আইএফএ-এর প্রাক্তন সচিব উৎপল গাঙ্গুলির অফিসার্স চয়েসের সঙ্গে। যেই আইএফএ-র সচিব পদ থেকে সরে গেলেন ঠিক তখনই উৎপলবাবু চুক্তি ভেঙে তিন বছরের মাথায় অফিচার্স চয়েস সরিয়ে নিলেন। হঠাৎ একদিন বলেছিলেন, আর টাকা দিতে পারবেন না। এমনটাই দাবি চিত্তবাবুর।
জয়দীপ মুখার্জির হোর্ডিং কোম্পানি আর্টেজ রেফারিদের স্পনসর করেছিল। তখন রেফারিরা জানতেন না বিএসএ দল (লিগে অংশ নেয়) জয়দীপের। কোনও কোম্পানির মালিকের দল কলকাতা লিগে খেলছে অথচ সেই কোম্পানি রেফারিদের স্পনসর করছে , এমনটা করা যাবে না। করলে তা রেফারিদের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এটা ভেবেই আর্টেজকে আর স্পনসর হিসেবে রাখতে পারেননি রেফারিরা। বলছিলেন চিত্ত দাস মজুমদার। কত কত সমস্যা।
তিনি জানান, “আর্থিক সমস্যা আমাদের আছেই। বকেয়া বেশ কিছু টাকা আইএফএ দিয়েছে। এখনও ৬ লক্ষ টাকা আইএফএ-এর কাছে পাবো। পাশাপাশি ক্লাবের বেশ কিছু সংস্কারের কাজ করতে পেরেছি ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সাহায্যে।”
সুব্রত দত্তর সময় কল্যাণীতে তৈরি হয়েছিল রেফারি অ্যাকাডেমি। উৎপল গাঙ্গুলি সেই অ্যাকাডেমি চালাতে পারেননি। বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গত বছর কিছু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রেফারি সংস্থা ও আইএফএ-এর যৌথ প্রচেষ্টায় ফের নিজেদের তাঁবুতে শুরু হয়েছে রেফারি অ্যাকাডেমি। অবশ্য করোনার জন্য গত ১০ মাস বন্ধ আছে।
নতুন প্রজন্ম আর রেফারি হতে চায় না। খুব কম সংখ্যায় মাঠে আসছেন। খাতা কলমে পরীক্ষা, শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা, ভাইবা, প্র্যাকটিক্যাল ম্যাচ পরীক্ষায় পাশ করলে সিআরএ (কলকাতা রেফারিজ অ্যাসোসিয়) থেকে পাশ করা রেফারির নাম পাঠাবে এআইএফএফে। পরে এআইএফএফ রিন নম্বর পাঠাবে। পাশ করা রেফারি পাবেন স্বীকৃতি (রেফারির ব্যাজ)। তারপর প্রাপ্তি? কলকাতা মাঠে প্রবল চাপ নিয়ে ম্যাচ খেলিয়ে পাবেন ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। ভাল বা অতি খারাপ খেলিয়ে হয়তো খবরের কাগজের শিরোনামে আসবেন। পাড়ায় একটু ওজন পাবে। কিন্তু বান্ধবী যখন বিয়ে করার জন্য চাপ দেবে তখন অসহায় সেই উদিয়মান রেফারি (এই ধরনের কয়েকটা উদাহরণ আছে)। অথবা বাড়িতে সারা বছর ঠিক মতো চার বেলা খাবার জোগাড় করতে পারবেন কিনা সেই রেফারি নিজেও জানেন না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তবু কিছু রেফারি মুখে বাঁশি নিয়ে মাঠে নামেন, নেশায়, ভালবাসায়। কিন্তু ম্যাচ খেলানোর জন্য শারীরিক সক্ষমতা যখন কমে যাবে তখন আর ম্যাচ পাবেন না। ওদের ভুলে যাবে সবাই। তখন সেই রেফারি কি করবেন? মুখে বাঁশিও নিই, চাকরিও নেই।
তখন কোথায় যাবেন ওঁরা?