সন্দীপ দে ◆ অযোধ্যা,পুরুলিয়া
এখনও খুব কম কথা বলেন ৪৪ বছরের নগেন সিং সর্দার। অযোধ্যা পাহাড়ের হিল টপে পৌঁছে খুব সহজেই নাগার ফোন নম্বর পাওয়া গেল। এলাকার ফুটবল প্রেমিরা নাগার নাম এখনও মনে রেখেছেন। প্রায় ১৭ বছর ফুটবল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নাগা এখনও জঙ্গলমহল ফুটবলের বড় নাম, বড় তারকা। বাংলার ফুটবলে সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে আসতে না আসতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। তাঁর করুন পরিণতির কাহিনী শুনলে চমকে উঠতে হয়। তখন তখন ১২ বছরের নগেন সিং সর্দার। পুরুলিয়ার বলরামপুর থানার মালতি গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে। সেই ছোট্ট বয়সে নগেন পুরুলিয়ার পাহাড়ে পাথর ভাঙার কাজ করতেন। সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত পাথর ভাঙার কাজ করে বিকেলে ফুটবল খেলতেন। পরের দিন সকালে ফের পাথর ভাঙা শুরু। এভাবেই চলছিল। কিন্তু তাঁর চমৎকার ফুটবল দেখে পুরুলিয়ার বলরামপুরের মঞ্জুর খান নগেনকে বুঝিয়ে,রাজি করিয়ে মালতি গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন রাঙাডি ভজন আশ্রমের স্কুলে। হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হল। ওই বয়সেই স্কুলে থেকেই পুরুলিয়া ফুটবলে হয়ে উঠলেন তারকা।
তাকে সবাই আদর করে ডাকতে শুরু করল ‘নাগা’ বলে। অসম্ভব গতি সঙ্গে স্কিল। স্ট্রাইকার নাগাকে আটকাতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারদের নাকি ঘাম ছুটে যেত। পরে সুব্রত কাপে নিজের জাত চেনায়। প্রসঙ্গত, সুব্রত কাপ কমিটি প্রতি বছর ভারতের স্কুল ফুটবলারদের মধ্যে সেরা পাঁচজনকে এক বছরের জন্য ভাতা দেয়। এক বছর ভারতের সেরা পাঁচ জনের মধ্যে নগেনও ছিলেন। তার এক বছরের মধ্যে ডাক পেলেন জুনিয়র বাংলা দলে। তখন কলকাতার সাইতে অনুশীলন হত। শরীর খারাপ। কবিরাজি চিকিৎসা করাবে বলে সেই যে বাংলা শিবির থেকে বাড়ি গেলেন আর সাই মুখো হননি। পরে নগেনের কাছে ডাক এলো মেয়র একাদশের থেকে। সেই বছর তুলসীদাস বলরাম মেয়র একাদশ দল গড়ার দায়িত্বে ছিলেন। বলরামের খুব পছন্দের ফুটবলার ছিলেন নাগা।পরে আবার পালিয়ে এলেন বাড়িতে।
ঐক্য সম্মিলনী, এভাররেডিতেও খেলেছেন। কিন্তু বারবার বাড়ি পালিয়ে আসতেন। একদিন পাকাপাকিভাবে কলকাতা ছেড়ে ফিরে এলেন পুরুলিয়ায়। ফুটবলের একদা তারকা নাগা ওরফে নগেনের এখন অতি কষ্টে দিন কাটছে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে। এই অযোধ্যার এক পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করেছেন। নাগা এখন দুই পুত্র সন্তানের পিতা। কোনও চাকরি নেই। ব্যবসা করার টাকাও নেই। তাই বেশিরভাগ সময় খাদানে পাথর ভাঙার কাজ করেন। জঙ্গলমহল ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারের এমন পরিণতির ঘটনা শুনে চমকে উঠেছিলাম।
রাজ্য সরকারের স্পোর্টস কাউন্সিলের সিনিয়র ফুটবল কোচ প্রবীর ভট্টাচার্য গত প্রায় ২০ বছর ধরে জঙ্গলমহলে বিভিন্ন জায়াগায়
ফুটবলের উপর কাজ করে চলেছেন এখনও। তিনিও একাটা সময় নাগার খেলা দেখেছেন। “নাগা অনেক বড় মাপের ফুটবলার ছিল। ওর মতো ফুটবলার জঙ্গলমহলে আর আসবে কিনা আমি জানি না। ওর কপাল খারাপ। এখন অর্থকষ্টে ভুগছে। একটা সিভিক পুলিশে চাকরি হলেও ওর মঙ্গল হতো।” বলছিলেন কোচ প্রবীরবাবু। “ইনসাইড স্পোর্টস-কে” তিনি বলছিলেন,”নাগার একটা কিছু করার জন্য পুরুলিয়া জেলার এসপি ও সভাধিপতির কাছে আমি ও মঞ্জুর খান গিয়েছিলাম। সবাই দেখছি দেখছি বলছে।”
ইউনাইটেড স্পোর্টসের (আগে ছিল এভাররেডি) অন্যতম শীর্ষ কর্তা আলোকেশ কুন্ডু বলছিলেন,”আমরা যখন সেকেন্ড ডিভিশনে খেলি তখন নগেন আমাদের ক্লাবে খেলত। ঘনঘন ছুটি নিয়ে বাড়ি পালাত। খুব ভাল মানের ফুটবলার ছিল। কলকাতায় থাকলে অনেক দুর যেত।”
নগেনের সঙ্গে এলাকায় আরও তিন ফুটবলারের নাম এখনও শোনা যায়। বাজার মাঝি, কৃষ্ণপদ এবং ফুলচাঁদ হেমব্রম। একটা সময় বাজাও (বাজার মাঝি) অসাধারণ ফুটবল খেলে মাঠে দর্শক টানতো। আর নাগার খেলা দেখতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে পিল পিল করে লোক মাঠে আসতো। এখন বাজার মাঝি কি করছেন কোনও খবর নেই। কৃষ্ণপদ পুলিশে একটি চাকরি পেয়েছেন। আর ফুলচাঁদ হেমব্রম একটা সময় বাংলা দলের হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছেন। পরে মহমেডান, পিয়ারলেস ও এরিয়ানেও খেলেছেন।
যে চার ফুটবলারের কথা উল্লেখ করলাম, জঙ্গলমহল ফুটবলে এরাই একমাত্র নজর কেড়েছে। এরা প্রত্যেকেই বলরামপুর থানার মালতি, ঘাটবেরা কেরোয়া এলাকার ছেলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ঘাটবেরা গ্রামটাই ছিল মাওবাদিদের অন্যতম ঘাঁটি। ২০১১ সালের পর মাও নেতা কিষেনজির খুন হওয়ার পর এই ঘাটবেরা কেরোয়ায় থাকা মাওবাদির ঘাঁটি বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময় মাওবাদিরা আদিবাসী পরিবারের ছেলেদের টাকা দিয়ে নিজেদের দলে নাম লেখাতো। নাগা, বাজার, ফুলচাঁদরা সে পথে না গিয়ে ফুটবলকেই বেছে নিয়ে ছিলেন।
আদিবাসী ফুটবলাররা খুব ভাল খেলে। গতি, স্কিল এবং শক্তি তিনটিই মারাত্মক। কিন্তু কলকাতার ময়দানে ব্যর্থ হয় কেন? কয়েক মাস আগে এই প্রশ্নর উত্তর জানতে চেয়েছিলাম পুরুলিয়ার শিক্ষক গৌতম চ্যাটার্জির কাছে। গৌতমবাবু, নিজে অ্যাথলিট ছিলেন। স্টেট মিটে অংশ নিয়েছেন বহুবার। বহু বছর ধরে আদিবাসী ছেলেদের নিয়েই কাজ করেছেন। সেই সময় তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলেছিলেন,””আদিবাসী ছেলে- মেয়েরা পুরুলিয়ার ফুটবল আর অ্যাথলেটিক্সটা বাঁচিয়ে রেখেছে। দারুন সব প্রতিভা। কিন্তু ওরা মানসিক ভাবে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। জেনারেল কাস্টদের সঙ্গে সেই ভাবে মিশতে পারে না। আর একটা সমস্যা হল, হোম সিকনেস। নিজের এলাকা ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারে না। নগেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কলকাতা ময়দানের চাপ নিতে পারে না। শিক্ষা একটা ব্যাপার। যারা ফুটবল খেলতে আসে তাদের পরিবারের সদস্যরা পড়াশোনা করতে পারেননি। ফলে হয় কি, জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক করতে পারে না। তারা একটুতেই সন্তুষ্ট। তাদের গভীর সমস্যা গুলি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার। ওদের সঙ্গে না মিশলে এই ব্যাপার গুলি আপনি বুঝতে পারবেন না।”
মঞ্জুর খান। যিনি কিশোর নগেনকে খাদানের কাজ করা অবস্থা থেকে তুলে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। এই মঞ্জুর খান এখন অযোধ্যা পাহাড় ও বলরামপুরে দু-দুটি ফুটবল কোচিং ক্যাম্প চালান। একই সঙ্গে কলকাতা লিগে খেলা ব্যাতোর স্পোর্টিংয়ের সভাপতিও। তিনি শিক্ষক গৌতমবাবুর যুক্তি মানলেন। আবার কলকাতায় জেলার ফুটবলারদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় বলে দাবিও কলেন। “আমার মনে আছে,নাগা তখন ঐক্য সম্মিলনীর ফুটবলার। ইস্টবেঙ্গল মাঠে লিগের ম্যাচে। প্রতিপক্ষ দল কে ছিল মনে নেই। বর্ষাকাল। নাগার ম্যাচের দিন মাঠে যেতাম। আমি সেদিনও গ্যালারিতে ছিলাম। ওই ম্যাচে নাগা হ্যাটট্রিক করেছিল। ম্যাচ শেষে ঐক্য সম্মিলনীর প্রত্যেক ফুটবলার জার্সি খুলে নাগার সামনে রেখে চলে গেল। আর নাগা সবার জার্সি কাচতে শুরু করল। আমি গ্যালারি থেকে নেমে ঐক্যর ম্যানেজারকে ডেকে বলেছিলাম, যে ছেলেটি হ্যাটট্রিক করল, তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে লজ্জা করল না? এভাবেই জেলার ছেলেদের হেও করা হয়।” বলছিলেন মঞ্জুর খান।
‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে নাগা ওরফে নগেন বললেন,”আমি ঘন ঘন বাড়ি চলে আসতাম। ভাল লাগত না। এখন বুঝতে পারছি, কলকাতা ছেড়ে এসে ভুল করেছি।”
প্রশ্ন : আপনার ছেলেও তো ভাল ফুটবল খেলে। ছেলেকে পরামর্শ দিচ্ছেন?
নগেন সিং সর্দার : আমি যে ভুল করেছি সেই ভুল যেন ছেলে না করে। লেখাপড়া করতেই হবে। তারপেই ফুটবল। দেখা যাক।
প্রশ্ন : খোঁজ নিয়ে দেখলাম শুধু অযোধ্যা পাহাড়েই আছে ছোট ছোট ৯১ টি গ্রাম। প্রত্যেক গ্রামে ফুটবল চর্চা আছে। বহু ছেলে ফুটবল খেলছে। জঙ্গলমহলের ফুটবল ভবিষ্যৎ কি?
নগেন সিং সর্দার : এখনকার ছেলেরা অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পায় কিন্তু সেইভাবে উঠে আসছে না।
প্রশ্ন : আপনার এখন লক্ষ্য কি?
নগেন সিং সর্দার : ছেলের লেখাপড়া আর সংসারট ঠিক ভাবে চালানো।
প্রশ্ন – কি করেন এখন? কি ভাবে সংসার চলে?
নগেন সিং সর্দার : ( অনেক্ষণ চুপ থাকার পর) সেরকম কিছু নয়। চলে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফোনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি বলে নাগা প্রায় দু ঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলেন এই সাংবাদিককে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারা যায়, দেরি করে আসার কারণ। খাদানে কাজ করছিলেন নাগা। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেননি।
নাগা কম কথা বলেন। নিজের নূন্যতম চাহিদার কথাও বন্ধু-পরিজনদের বলেন না। বলতে পারেন না। আইএফএ বা কোনও সহৃদয় ব্যক্তি কি নাগার পাশে দাঁড়াতে পারেন না?