◆সন্দীপ দে◆
আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখার্জির ভূমিকায় প্রচন্ড বিরক্ত বাংলার রেফারিদের একাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলার প্রথম সারির বেশ কিছু রেফারি আছেন যারা সিআরএ (কলকাতা রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশন) -এর সচিব সুকৃতি দত্তর উপরেও যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন। গত দশদিন ধরে ‘ইনসাইড স্পোর্টস’ বাংলার বিভিন্ন রেফারিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, অদুর ভবিষ্যতে কিছু রেফারি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। কি সেই সিদ্ধান্ত? বিধিনিষেধ থাকার কারণে এখনই তাঁরা পরিস্কার করে কিছু বলতে নারাজ। এক প্রাক্তন ফিফা রেফারি বলছিলেন,”রেফারি হল মাঠের বিচারপতি। তাঁকে যদি রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্থা নিজের দফতরে ডেকে পাবলিকলি ‘হলুদ কার্ড’ দেখায় তাহলে সেই বিচারপতি মাঠে নেমে স্বাধীনভাবে বাঁশি বাজাতে পারবে? যা ঘটেছে তা বাংলা রেফারিদের কাছে একটা কালো অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। অতীতে যা কখনও এমন হয়নি। সলতে পাকানো শুরু হয়েছে। কিছুদিন অপেক্ষা করুন। সব জানতে পারবেন।”
কি এমন ঘটল যে, রেফারির একটা অংশ ক্ষব্ধ হয়ে উঠলেন? ঘটনার সূত্রপাত, এবারের লিগের নকআউট কোয়ালিফাইয়ের মহমেডান ও টালিগঞ্জ ম্যাচ রেফারি তন্ময় ধরের একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে। মহমেডানের এক ফুটবলারের হ্যান্ডবল হওয়ায় তাকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি তন্ময়। তারপর থেকেই যত বিতর্ক শুরু বাংলার ফুটবলে।
এই ঘটনার পর সবাইকে অবাক করে রেফারিদের বিরুদ্ধে সোসাল মিডিয়ায় কিছু মন্তব্য করেন আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখার্জি। তিনি বলেছিলেন, ১)রেফারিদের নিয়ে একাধিক ক্লাব অভিযোগ করেছেন। ২) রেফারিদের মান সেই উচ্চতায় হচ্ছে না। ৩) রেফারি পোস্টিং নিয়ে ভাবছে। ৪) মান না বাড়লে রেফারিজ বোর্ড গঠন নিয়ে ভাবতে হবে। প্রয়োজন হলে ৯ ওয়াই ধারা অনুযায়ী সিআরএ ভেঙে দিতে পারে আইএফএ। ৫) রেফারিদের মধ্যে অন্তর্কলহ বেশি এবং ৬) এই ভাবে চলতে থাকলে আসন্ন আইএফএ শিল্ডে বাইরের রেফারি নিয়ে ম্যাচ খেলানো হবে।
এই বিবৃতির পরেই মহমেডান – টালিগঞ্জ ম্যাচ রেফারি তন্ময় ধরকে তলব করে আইএফএ। সংশ্লিষ্ট ম্যাচের বিতর্কিত অংশ (হ্যান্ডবল ও লাল কার্ড) ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে সেদিন তন্ময়কে বলা হয়, তিনি ঘটনাস্থল থেকে অনেকটাই দুরে ছিলেন। আর বল মহমেডানের ফুটবলারটির হাতে লেগেছে কিনা স্পষ্ট নয়। সূত্রের খবর, আত্মপক্ষের সমর্থনে যথাযথ নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাননি তন্ময়।
প্রশ্ন উঠছে,লিগের মাঝপথে হঠাৎ মডালিটি বদল করে আইএফএ জানিয়ে দিয়েছিল, গ্রুপ লিগের (নকআউট কোয়ালিফাইয়ের ম্যাচও এর মধ্যে পড়ছে) লাল কার্ড বা হলুদ কার্ড কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে গ্রাহ্য হবে না। তাই যদি হয়,তাহলে রেফারি তন্ময়ের দেখানো লাল কার্ড এমনিতেই পরের ম্যাচে গ্রাহ্য হবে না। তাহলে কেন রেফারি তন্ময়কে ডেকে ‘চমকে’ দেওয়া হল? প্রকাশ্যে এই ভাবে রেফারিদের সমালোচনা আইএফএতে হয়তো প্রথম ঘটল। ঘটনাটি যখন ঘটল তার কদিন পরেই মহমেডানের ম্যাচ। তার আগে আইএফএ সচিবের এহেন অতি সক্রিয়তা চোখে লেগেছে সবার।
অতীতে লিগের ইস্টবেঙ্গল- ইস্টার্নরেল ম্যাচে ১৭ মিনিট বেশি খেলানো হয়েছিল। শোনা যায় সেই দিন নাকি রেড রোডের লাইটও জ্বলে উঠেছিল। তবু ম্যাচ চালানো হয়। তাই নিয়ে সংবাদপত্রে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু কখনই প্রকাশ্যে আইএফএতে ডেকে রেফারিকে চাপে ফেলা হয়নি। এই ব্যাপারে প্রাক্তন ফিফা রেফারি প্রদীপ নাগ ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে জানান,” অতীতের সেই ম্যাচে অতিরিক্ত ১৭ মিনিট ম্যাচ খেলানো হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ম্যাচটা মাঝখানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়টা খেলানো হয়েছিল। এটা ঠিক, তন্ময় ধরকে ডেকে বিষয়টা যেভাবে প্রকাশ্যে আনা হয়েছে তার দরকার ছিল না। আমাকে অবাক করেছে, যারা বিচার করলেন তাদের মধ্যে কেউ টেকনিক্যাল লোক ছিল না।”
এক সিনিয়র রেফারি বলছিলেন, “রেফারিদেরও ভুল হতেই পারে। তার জন্য নিদিষ্ট কমিটি আছে। ভুল হলে সেই রেফারিকে ফ্রিজ করার নিয়ম আছে। সব দেশে তাই হয়। কখনও প্রকাশ্যে, সবাইকে জানিয়ে কাউকে ছোট করা হয় না। আইএফএ প্রকাশ্যে রেফারিদের অপমান করল। এই ভাবে চললে নতুন ছেলেরা আর রেফারি হতে আসবে না। আর যে কটা ভাল রেফারি আছে তারা যদি ভিন রাজ্যে চলে যায় কার মুখ পুড়বে? সিআরএ না আইএফএ-এর?”
আইএফএ সচিবের এহেন মন্তব্য,ভূমিকা মেনে নিতে পারছেন না একাধিক রেফারি। বিধিনিষেধ থাকায় তারা মুখ খুলতে পারছেন না। তারা আরও বেশি বিরক্ত হয়েছেন সিআরএ সংস্থার সচিব সুকৃতি দত্তর উপর। আইএফএ সচিব বাংলার রেফারিদের যেভাবে প্রকাশ্যে অপমান করেছেন তার প্রতিবাদ করে একটা শব্দও খরচ করেননি সুকৃতিবাবু।
প্রশ্ন : আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখার্জির মন্তব্যর পর আপনি কোনও প্রতিবাদ পত্র দিলেন না। তাহলে কি ধরে নেব,জয়দীপবাবু যা বলেছেন সেই বক্তব্যকে আপনি মান্যতা দিলেন? নাকি কোনও ‘অদৃশ্য’ চাপের জন্যই চুপ থাকলেন?
সুকৃতি দত্ত : এই মুহূর্তে কিছু বলছি না। এই ভাবে উত্তর দিতে পারব না। আশাকরি আগামী সাতদিনের মধ্যেই উত্তর পেয়ে যাবেন।”
প্রশ্ন : আপনি একটা সময় স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছেন। যখন সিআরএ- র ট্রেজারার ছিলেন তখন আপনাদের সংস্থার তহবিলের অনেক দুর্নীতি সামনে এনেছিলেন আপনি। এখন সেই সুকৃতি দত্ত নাকি নামেই সিআরএ সচিব। বকলমে এখন সিআরএ চালাচ্ছেন প্রাক্তন রেফারি কাশীনাথ সেন ও চিত্তদাস মজুমদার। এমনটাই অভিযোগ উঠে আসছে। কতটা সত্যি?
সুকৃতি দত্ত : (প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বললেন) দেখুন ভাই, আমার উপর কেউ লাঠি ঘোরাচ্ছে এটা ঠিক নয়। এটা মাথায় রাখবেন না। দেখুন না কি হয়।”
এবারের আইএফএ–রেফারি বিতর্ক নিয়ে একাধিক ক্লাব কর্তাও অবাক হয়েছে। অনেকের ধারণা ‘তিল’ থেকে ‘তাল’ করা হয়েছে। কোনও ক্লাবকে সুবিধা পাইয়ে দিতে। একাধিক প্রশ্ন উঠছে। ভিএআর (ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। মহমেডান-ভবানীপুর ম্যাচে ভিএআর প্রয়োগ হল। অথচ মহমেডান-ইউনাটেড স্পোর্টসের ম্যাচে বিতর্কিত ফাউল (পেনাল্টি) ভিএআর প্রয়োগ হল না কেন? ইউনাইটেডের ম্যাথ্যুকে যেভাবে ফাউল করা হয়েছিল সেখানেও ভিএআর প্রয়োগ হয়নি।
প্রদীপ নাগ বলছেন,”ভিএআর সিস্টেম প্রয়োগ করার মত পরিকাঠামো আমাদের লিগে নেই।” তাহলে ভবানীপুর ম্যাচে হল কি করে?
এবার ইউনাইটেড স্পোর্টস দুর্দান্ত খেলেছে। লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম। ম্যাচের পর ইউনাইটেড স্পোর্টসের অন্যতম কর্তা নবাব ভট্টাচার্য সোসাল মিডিয়ায় সিস্টেমের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা সরকারিভাবে আইএফএ-এর কাছে কোনও অভিযোগ করেননি। সেটাও রেফারিদের অবাক করেছে। এক প্রাক্তন ফিফা রেফারি বলছিলেন,”নবাব অনেক প্রশ্নই তুলেছে। সেই প্রশ্নর উত্তর রেফারিরা কেন দেবে? সোসাল মিডিয়ায় সরব হল। রেফারি প্রতীকের জন্যই নাকি এবার লিগ পেল না ইউনাইটেড। অথচ তারা সরকারি ভাবে আইএফএকে একটা প্রতিবাদ করে চিঠি দিতে পারেনি। আসলে সবাই রেফারিদেরই টার্গেট করে। আসল জায়গায় ঢিলটা মারতে পারে না।”
কয়েক বছর আগে ইউনাইটেডের কোচ এলকো সাত্তোরি কলকাতায় এসে সাংবাদিকদের কাছে লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের তালিকা জানতে চেয়েছিলেন। তালিকা পেয়ে দেখলেন হয় মোহনবাগান, নয় ইস্টবেঙ্গল – এই দুটি দলই চ্যাম্পিয়ন হয়। সেদিন সাত্তোরি ছোট্ট করে বলেছিলেন,”ইটস নট আ গুড ফুটবল ফর বেঙ্গল” এবার মোহনবাগান,ইস্টবেঙ্গল নেই। আছে শুধু মহমেডান। ৪০ বছর পর লিগ জেতার সুর্বন সুযোগ। হয়তো মহমেডান জিতবে। সবাই শুভেচ্ছা জানাবে। আমরাও বড় বড় করে লিখব। শুধু কোচ সাত্তোরির কথা গুলি (“ইটস নট আ গুড ফুটবল ফর বেঙ্গল”) লিখতে পারব না।