ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন,২২ মার্চ : যারা প্রচারের আলোর বাইরে থেকে এতদিন মাঠ করে গিয়েছেন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে ফুটবলার তুলে নিয়ে এসে দল গড়েছেন। সেই সব অখ্যাত ফুটবলারদের বিখ্যাত করার মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন। অথবা কেউ ফুটবলের পরিকাঠামো তৈরি করে গিয়েছেন সেই কর্তাদের আজ স্বীকৃতি দিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। গত কয়েক মাস আগে “ইনসাইড স্পোর্টস” এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল, ফুটবলার তৈরির কারিগরদের কোনও ট্রফি নেই। থাকে না। ওঁরা নীরবে কাজ করে যায়। অবশেষে সেই সব ফুটবলার তৈরির কারিগরদের স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।
এদিন, মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রয়াত সচিব পল্টু (দীপক) দাসের প্রয়াণ দিবস অনুষ্ঠানে ‘দীপক জ্যোতি’ সম্মান বাংলার ফুটবল ময়দানের ৫ কর্তার হাতে তুলে দেওয়া হল। এই ৫ কর্তারা হলেন অলোকেশ কুন্ডু,নীলিমেশ রায় চৌধুরী, বিশ্বপ্রতিনাথ মিত্র, পৃত্থীজিৎ ঘোষ এবং সঞ্জয় চক্রবর্তী।
অলোকেশ কুন্ডু ময়দানে পরিচিত ‘আলো’ নামে। ছাত্র রাজনীতি করতে করতে কসবার অলোকেশের ময়দানে প্রথম আসা ভ্রাতৃ সংঘ ক্লাবে। তারপর থেকেই ময়দানই তাঁর ঘর-বাড়ি। ফুটবলের নেশায় তখন আচ্ছন্ন। ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকলেন। ছোট ক্লাব থেকে বড় ক্লাবে অবাধ যাতায়াত শুরু। নতুন ফুটবলার তুলে আনতে ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন জেলার গ্রামে। অলোকেশের মাঠ করার সক্রিয় ভূমিকা দেখে ভাল লেগে যায় তৎকালীন ডাকসাইটে কর্তা প্রদ্যোৎ দত্তর। পরবর্তীকালে নিজে এভাররেডি ক্লাব কিনে নিয়ে এগিয়ে যান ময়দানের ‘আলো।’
মনের ইচ্ছে থাকলে লক্ষ্য পূরণ করা যায়। তার উদাহরণ এই অলোকেশ কুন্ডু। ভ্রাতৃ সংঘ থেকে বেড়িয়ে তিনি এভাররেডি ক্লাব কিনে স্বাধীন ভাবে ফুটবলের কাজ শুরু করলেন। তারও পরে এভাররেডি নাম বদলে ইউনাইটেড স্পোর্টস করলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টের শীর্ষে পৌঁছনোর। পঞ্চম ডিভিশন থেকে আই লিগের মূল পর্বে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তার দলকে। টানা আট বছর আই লিগে খেলেছে তাঁর দল। সুনীল ছেত্রী,র্যান্টি মার্টিন দীপক,সন্দীপ নন্দী বা এলকে সাত্তোরি কে ইউনাইটেডে আসেনি!
এই অলোকেশ একাধিক ফুটবলারের চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সন্তোষ ট্রফি খেললেই সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের সার্টিফিকেট নিয়ে বিভিন্ন সরকারি,বেসরকারি অফিসে পৌঁছে যেতেন। শুধু ফুটবলারটির চাকরির জন্য। সেই সব অফিস কর্তাদের বার বার অনুরোধ করে চাকরি করিয়েই ছেড়েছেন অলোকেশবাবু।
এই সেদিনও তাঁর এক অফিসের সহকর্মী ‘ইনসাইড স্পোর্টস’কে বলছিলেন,” আপনারা অনেকেই জানেন না, আলোদার তিনবার প্রোমোশন হয়েছিল। একবারও প্রোমোশন নেননি। আজ তিনি প্রোমোশন গুলো নিলে অনেক বড় পদে চলে যেতেন। প্রোমোশন নিলে অফিসে বেশি সময় দিতে হবে। মাঠ করার সময় পাবেন না। ফুটবল মাঠ করবে বলে প্রোমোশন নেননি। জাস্ট ভাবা যায় না।”
অলোকেশবাবু বিয়ে করেননি। নবান্নের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। চাকরির টাকায় দল গড়েছেন। তাঁর জীবনে একটাই প্রেম – ফুটবল। অফিসের কাজ সেরে ময়দানে পৌঁছে যান। ক্লাব,মাঠ ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যায় খিদিরপুর ক্লাবে প্রখ্যাত কর্তা ভুতনাথ বিশ্বাসের দুই পুত্র সিদ্ধার্থ বিশ্বাস (বুবুন)ও অমিতাভ বিশ্বাস (টুলু) সহ ময়দানের একাধিক কর্তার ফুটবল আড্ডায় আলো করে বসে থাকেন অলোকেশ কুন্ডু।
এদিন,পুরস্কার মঞ্চে স্মারকের সঙ্গে যে আর্থিক পুরস্কার পান, সেই চেকটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মালিদের দিয়ে দিলেন অলোকেশ কুন্ডু।
নীলিমেশ রায় চৌধুরী। শিলিগুড়ির মানুষ হলেও কল্যাণীতে বসবাস বহু বছর থেকেই। এই নীলিমেশবাবুই হলেন কল্যাণী স্টেডিয়ামের আধুনিক রূপকার। কল্যাণী পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শান্তনু ঝাঁ প্রথম কল্যাণী স্টেডিয়াম তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে নীলিমেশ রায়চৌধুরী এই কল্যাণী স্টেডিয়ামের দায়িত্ব নিয়ে চেহারাটায় বদলে দিয়েছেন। তিনি ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে কল্যাণীকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে কল্যাণী স্টেডিয়াম,ফুটবলে মুখ হচ্ছেন কল্যাণী পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান নীলিমেশ রায় চৌধুরী। তিনি একাধারে ক্রীড়া সাংবাদিক,ভাষ্যকার,নাট্যকার এবং অবশ্যই দক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক।
অলোকেশ কুন্ডু, নীলিমেশ রায় চৌধুরী ছাড়াও ‘দীপক জ্যোতি’ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয় তিন কর্তা বিশ্বপ্রতিনাথ মিত্র, সঞ্জয় চক্রবর্তী, পৃত্থীজিৎ ঘোষকে।
বিশ্বপ্রতিনাথ মিত্র। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিরাটির মাইকেল নগরে থাকেন। তিনিও ছোটদের নিয়ে কাজ করেছেন নীরবে। পৃত্থীজিৎ বসু উত্তর২৪পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় একটা সময় সচিব ছিলেন। তিনিও নিজের চেকটি ইস্টবেঙ্গলের ছোটদের জন্য দিয়ে দিলেন।
উত্তরপাড়ার নেতাজি ব্রিগেডের মধ্যে দিয়ে বহু ফুটবলার তুলেছেন সঞ্জয় চক্রবর্তী। তাঁকেও ‘দীপক জ্যোতি’ সম্মান দেওয়া হয়।
এদিন,এই পাঁচ কর্তার পাশাপাশি বাংলার তিন ধারাভাষ্যকার প্রয়াত অজয় বসু,পুষ্পেন সরকার ও কমল ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হাতে স্মারক তুলে দেয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুভাষ ভৌমিক, ভাস্কর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য থেকে মিহির বসু, অলোক মুখার্জি, চিন্ময় চ্যাটার্জিরা। ছিলেন ফেডারেশনের সহসভাপতি সুব্রত দত্ত সহ ইস্টবেঙ্গলের এক ঝাঁক কর্তা।