অবহেলায় চলে গেলেন ক্রীড়া গবেষক, সাংবাদিক শিবরাম কুমার

0

ইনসাইড স্পোর্টসের প্রতিবেদন, ২৪ এপ্রিল, কলকাতা : ক্রীড়া জগতে একটার পর একটা মৃত‍্যু ঘটে চলেছে। এবার চলে গেলেন গড়ের মাঠের “গ‍্যালারি”-র প্রধান সম্পাদক ও বাংলার ক্রীড়া জগতের গবেষক, সাংবাদিক শিবরাম কুমার। প্রায় ১০ বছর ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। গত তিন সপ্তাহ ধরে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। ১৬ এপ্রিল বিটি রোডের এক নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হন। বছরের পর বছর ময়দানে এককভাবে জীবন সংগ্রামের লড়াই করে মাথা উঁচু করেই ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলনা। আজ, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় শিবরাম কুমারের মৃত‍্যু হয়। মৃত‍্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

কে এই শিবরাম কুমার? বাংলার নতুন প্রজন্মের ক্রীড়াপ্রেমীরা হয়তো জানেন না। সাতের দশকে কলকাতা গড়ের মাঠে তখন বেশ কিছু ক্রীড়া পত্রিকা প্রকাশ হয়। ‘ক্রীড়ানন্দ’, ‘অলিম্পিক’, ‘গড়ের মাঠ’, খেলার মাঠ,’ময়দানে’ এবং ‘গ‍্যালারি’। তখনও ‘খেলার আসর’ বা ‘খেলার কথা’ বাজারে আসেনি। সাতের দশকে শিবরাম কুমার শুরু করেছিলেন সাপ্তাহিক ক্রীড়া পত্রিকা ‘গ‍্যালারি’। ওই সময় খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল শিবরামবাবুর ‘গ‍্যালারি’। ওই কাগজে লেখার পর অনেকেই সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এদের মধ‍্যে অন‍্যতম হলেন সরোজ চক্রবর্তী (আজকালের প্রাক্তন ফুটবল বিভাগের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট) ও নীলিমেশ রায় চৌধুরী (সাংবাদিক, ধারাভাষ‍্যকার, ক্রীড়া সংগঠক)।

সাতের দশকের শেষ দিকে সরোজবাবু তখন তরুণ ক্রীড়া সাংবাদিক। ওই সময় ‘গ‍্যালারি’-তে ইস্টবেঙ্গলের দাপুটে কর্তা নিশীথ ঘোষ গোষ্ঠীর বিরদ্ধে ধারাবাহিকভাবে কড়া প্রতিবেদন লিখতে থাকেন। শিবরামবাবু পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন সরোজ চক্রবর্তীকে। ওই লেখার জন‍্য ইস্টবেঙ্গলের কর্তা নিশীথ ঘোষ ‘গ‍্যালারি’-র বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কিন্তু মামলার ভয়ে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি ‘গ‍্যালারি’ সম্পাদক শিবরাম কুমার।

আসলে শিবরাম কুমার শুরু থেকেই কিংবদন্তি সাংবাদিক রাখাল ভট্টাচার্য ও শ‍্যামসুন্দর ঘোষের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। মূলত তাঁদের পরামর্শ নিয়েই কাজ করতেন। তিনি গবেষনামূলক ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতেন। বাংলায় আজ যে সমস্ত ক্রীড়া সাংবাদিক ফুটবল ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন তার বড় কারণ শিবরাম কুমার।

একার উদ‍্যোগে রাখাল ভট্টাচার্যর বাংলা ফুটবলের মহামূল‍্য লেখা বই আকারে শিবরামবাবুই প্রকাশ করেন। আর বি প্রণীত ‘কলকাতার ফুটবল’ বইটি সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করে প্রকাশ করেন তিনি। এই জন্য তিনি প্রভাবতী প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনাও শুরু করেন। শিবরাম কুমারের প্রথম বই ছিল ‘পেলে ফুটবলের বাদশা’। পরবর্তী বই ‘ক্রিকেটের জাদুকর স্যার ডন’। ‘মোহনবাগান অমনিবাস’ সম্পাদনা করেন। এছাড়াও ‘কলকাতা স্পোর্টস কুইজ’, ‘বিখ্যাত ক্রিকেটারদের ছেলেবেলা’ এবং ‘সোনার ফ্রেমে মোহনবাগান ১৯১১’ লিখেছিলেন।

বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিক জগতে শিবরাম কুমারের অবদান কখনও ভোলার নয়। অথচ জীবদ্দশাতে তাঁর কাজের মূল‍্যায়ন হয়নি। কেউ সেভাবে সম্মান জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। যদিও দেরিতে হলেও তাঁর জীবনের শেষ দিকে কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাব একটা সংবর্ধনা ও অসুস্থতার জন‍্য আর্থিক সাহায‍্য করেছিল।

শিবরাম কুমারকে অত‍্যন্ত ভালবাসতেন স্টেটসম‍্যান পত্রিকার স্পোর্টস এডিটর শ‍্যামসুন্দর ঘোষ। তাঁরও বয়স হয়েছে। এখন তিনি ‘প্রাক্তন’। ‘ইনসাইড স্পোর্টসে’র এই সাংবাদিকের কাছে শিবরাম কুমারের মৃত‍্যুর খবরটা পেয়ে কিছুক্ষনের জন‍্য চুপ করে গিয়েছিলেন। তারপরেই শ‍্যামসুন্দরবাবু বলতে থাকেন,”খুব খারাপ খবর দিলে সন্দীপ। শিবরাম আমার খুব কাছের ছিল। কিন্তু বার্থক‍্যের কারণে ইদানিং যোগাযোগ ছিল না। শুনে রাখো, শিবরাম না থাকলে অনেকের পক্ষে বাংলার ফুটবল নিয়ে লেখা সম্ভব হত না। আজ যারা সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা প্রত‍্যেকে শিবরামের বই পড়ে উপকৃত। রাখাল ভট্টাচার্যকে মাথায় রেখেও বলছি, বাংলার ক্রীড়া সাংবাদিকতায় শিবরামের কৃতিত্ত্ব কোনও অংশে কম নয়।”

শিবরাম কুমারের জনপ্রিয় ‘গ‍্যালারি’-তে সাংবাদিকতা করে হাত পাকিয়েছিলেন সরোজ চক্রবর্তী। তিনি ‘ইনসাইড স্পোর্টস’-কে বলছিলেন,”শিবরামদা ছিলেন একজন বড় মাপের সম্পাদক। তিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না। বাংলার ফুটবল নিয়ে গবেষণা করেছেন। শিবরামদা যা অবদান তার মূল‍্যায়ন করা হয়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তবে তাঁকে এই নিয়ে কখনও আক্ষেপ করতে শুনিনি। জানি না, ভবিষ্যতে তাঁর কাজের মূল‍্যায়ন হবে কি না।”

সত‍্যিই তিনি বাংলার ফুটবল সমাজ থেকে কোনও স্বীকৃতি পাননি। না পেয়েছেন সম্মান, না পেয়েছেন প্রাপ‍্য অর্থ। চিরকাল অবহেলায় কাটাতে হল শিবরামবাবুকে। এমনও হয়েছে, রেশন কেনার টাকা নেই। কাউকে বলতে পারেননি। তাঁরই সম্পাদনা করা শ‍্যামসুন্দর ঘোষের ‘বিশ্ব ফুটবলের সুপার স্টার’ বই বিক্রি করে সেদিন নিজের সংসারের রেশন কিনতে পেরেছিলেন। তবু কারও কাছে হাত পাতেননি। শেষ দিকে বই প্রকাশ করে জেলায় জেলায় গিয়ে বই বিক্রি করতেন। ভাবা যায়? পরে যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন তখন থেকে তাঁর লেখা বন্ধ হয়ে যায়। এমন একজন বড় মাপের ক্রীড়া গবেষক, সাংবাদিকের শেষ পরিণতি দেখে একটা শব্দই লিখতে ইচ্ছে করছে – লজ্জা। এ লজ্জা আমার, আপনার, ক্রীড়া জগতের, রাজ‍্য সরকারেরও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here